কিছুটা দূরে একটি লাগাম-ছাড়া ঘোড়া সমুদ্রের তীর ধরে মৃদুগতিতে হাঁটছিল। যেন ওর কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই, অথবা সমুদ্রের বিশালতার সামনে ওর গতি থমকে যাচ্ছিল।
আমি একটি ক্যানন এর ক্যামেরা হাতে তখন ফোকাস করতে চাইছিলাম ঘোড়ার দিকে, অথবা সমুদ্রের দিকে, অথবা ঘোড়াসহ সমুদ্রের দিকে।
এটা কক্সবাজারের বেশ নির্জন একটা স্থান৷ লোকজন কম, তাই বলে নেই এমনটা নয়।
আমি ছবির ফ্রেমে শুধু ঘোড়া আর সমুদ্রই চাইছিলাম,আর খালি সেখানে একটা পাগলাটে ধরনের লম্বা লোক সবুজ ফুলহাতা জামা আর খয়েরি ফুলপ্যান্ট পরা… সে বারবার চলে আসছিল। একটু টলছিল ওই লোকটা। এতটাই রোগা যে মনে হচ্ছিল সমুদ্রের হাওয়ায় ও টাল সামলাতে পারছে না… অমনই টলতে টলতে একসময় সে ডিফ্রেম হল। আর, আমি ছবিখানি তুলতে পারলাম। এত সময় নিয়ে তুলেছিলাম ছবিটি যে বাড়ির লোকজন অধৈর্য্য হচ্ছিল, তবু, শেষমেশ সে ছবি উঠল। বাড়ির বড়রা পরে ছবি দেখে খুব ঠাট্টাকরে বলেছিলেন
– বাহ্.. বেশ দার্শনিক ছবি
আমারপাশে দাড়িয়ে অনন্যা ভাবি আবার সচেতন পরামর্শ দিল,
– এমন একলা একলা ভাবের ছবি তোলো কেন! দেখে কেমন দু:খু হয়!...আচ্ছা তোমার কি হয়েছে বলো তো?
আমি ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলাম।তারপর তার শান্ত মুখের দিকে থেকে মুখ সরিয়ে ক্যামেরার চোখ রেখে শান্ত স্বরে বললাম,
– আমার আবার কি হবে! তুমি ভাইয়ের কাছে যাও তো,কেমন একা বসে আছে, দেখতে খারাপ দেখায়।
ভাবির বোধহয় যাওয়া��� ইচ্ছে ছিল না। সে তার বড় বড় চোখ গুলো সংকোচিত করে আমার দিকে চেয়ে রইলো।
আমার বড় পরিবারের এই একটি মানুষকে কেউ ফাঁকি দিতে আজ পর্যন্ত সফল হয়েছে কি না,তা আমি সঠিক ভাবে জানি না। তাই ভাবিকে সেখানে রেখে আমি সরে পরলাম।
সময়টা ২০২৩, এক বর্ষার বিকালে সাগরের পারে ক্যামেরা হাতে খালি পায়ে ভেজা বালির ওপড়ে হাটছি। আর মনে মনে এমনি এক বর্ষার দিনে ঘটে যাওয়া আমাদের একটি ঘটনার ভয়াবহতাকে ভুলতে চাইছিলাম।দাঁড়াও এখানে বোধকরি "আমাদের" শব্দটা ব্যবহার করা ঠিক হল না, কারণ এখন আমাদের বিচ্ছেদ হয়েছে প্রায় সাত বছর হলো। তো সে যাইহোক, ঠিক এমনি একদিনে তখনকার প্রিয়জনকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি গেছে।
তিন বছরের প্রেমের পর আমাদের বিয়ের দিনেই সে মারা গেল।আর এই ঘটনার প্রায় সপ্তাহ খানেক পরেই আমি ঠিক করলাম বিদেশ পারি জমাবো। হলোও তাই, মাস দুই একের মধ্যেই আমি জার্মানির একটা ফ্লাইটে উঠে পরলাম।এরপর..সে কথা না হয় নাই বা বললাম,নিজের দুঃখ ভ্রমণ কাহিনী ছড়িয়ে দিয়ে লাভের কিছু তো নেই। উল্টো মানুষের জার্মানির সম্পর্কে ভয় তৈরি হবে
আজ সাত বছর পরে আবারও দেশে। কারণটি বিয়ে! আমাকে ভুল বুঝতে পারো। কিন্তু এই বিয়েতে আমার মত নেই। এমনকি আমি যদি আগে জানতাম, তবে দেশের মাটিতে পা ফেলতাম না।তবে ওই যে বললাম, পরিবারের সবাইকে ফাঁকি দিলেও অনন্যা ভাবীকে ফাঁকি দেওয়া খুবই কঠিন কাজ।
হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা এগোতেই পেছন থেকে অনন্যা ভাবী ডাকলো,
– আহান দাঁড়ায় একটু !!
একটু চমকে গিয়েছিল আমি। আসলে ভাবতে ভাবতে একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম কিনা তাই। পেছনে ফিরে দেখলাম, অনন্যা ভাবী নিজের খোলা ও অবাধ্য চুলগুলোকে ডান হাতে শাসন করতে করতে এগিয়ে আসছে। বাতাসে তার হালকা নীল রঙের আঁচল খানি উড়ে যেতে চাইছে বারবার। ইচ্ছে না থাকলেও চোখ নামিয়ে নিতে নিতে তার খালি পায়ে পরা নূপুরের দিকে চোখ গেল।তারপর চোখ ফেরাতেই আবারও চোখের সামনে সমুদ্র,দূরে দুই একটা সাম্পান।
ঝর্ণার সমুদ্র খুব পছন্দ ছিল। না, আবারও অতিতে চলে গেল মনটা। তবে বেশি দূর যাওয়া হলো না।ফিরে আসতে হলো ভাবীর ডাকে।
– আহান! কোথাও বসবে চলো।
আমি হাসি মুখে ভাবীর দিকে তাকিয়ে বললাম, না, আমার সাথে কথা বলতে হলে হাঁটতে হবে।
বলেই আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম।মনে মনে ভাবলাম বোধকরি হাঁটতে হবে ভেবে ফিরে যাবে আবার। আমি যতটুকু জানি অনন্যা ভাবী হাঁটতে ঠিক পছন্দ করে না। কিন্তু আমাকে অবাক হতে হলো। সে আমার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় আমার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। আমি একটু পর পর তার দিকে তাকিয়ে ���েখছিলাম।তার মুখে বিরক্তি, ও অস্থিরতার ছাপ স্পষ্ট।এক সময় আর থাকতে না পের বলেই ফেললাম।
– কোথায় বসবে বল?
আমার কথাটা তার কানে যাওয়া মাত্রই সে ভেজা বালির ওপড়ে দুই হাটুতে হাতরেখে বসে পড়লো।
– আহা..ওকি কর! ভিজে যাবে যে।
– ও চিন্তা তোমার না করলেও চলবে,এখন আমার পাশে বসে পরতো দেখি।
আমার না বলার উপায় নেই।সুতরাং আমাকেও বসতে হলো।আর তার সাথে সাথেই একটা ঢেউ এসে আমার পা ছাড়িয়ে একদম পাছা অবধি ভিজিয়ে দিল। অবশ্য এতে আমার পাশে বসা রমনীর কোন বিকার নেই। সে মুখে মিষ্টি স্বরখানি যতটা সম্ভব গম্ভীর করে বলল,
– তো বিয়েটা করছো এবার, শেষমেষ পালাবে না তো!
আমি একটু হেসে বললাম, তুমি পালাতে দিলে তবে না পালাবো। সে সুযোগ পাচ্ছি কোথায় বল। আমার পাসপোর্ট নিয়েও তো তোমার শান্তি নেই।এখনো চোখে চোখে রাখছো,পালানোর উপায় কি আমার বল!
আমি কথা শেষ করে দেখলা ভাবী তার হাটুতে মাথা কাত করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।তবে অবাক হলাম তার চোখে অশ্রু দেখ���।
কেনো যেন মনে হলে তার অশ্রু কারণটি আমি। যার সাথে দিনের বেশিরভাগ সময় কাটতো। আজ পাঁচ বছর পরে এই প্রথম কথা।তাও আমার মনটি পালাই পালাই করছে।
– মনে আছে আহান আমি যখন নতুন এসেছিলাম তোমাদের বাড়িতে,আমি কাঁদছিল বলে তুমি পাশে বসে ছিলে। তোমার ভাইকে ঘরে ঢুকতে দাওনি বা যখন হাসপাতালে শুয়েছিলাম আমি,তোমার ভাই সেদিন দেশের বাইরে। তুমি বলেছিলে কখনো ছেড়ে যাবে না।
আমি তাকিয়েই ছিলাম তার মুখের দিকে। বলতে বলতে এক সময় গাল ফুলিয়ে কাঁদতে বসে গেল।
– আরে দেখ দেখি কি কান্ড, কাঁদছো কেন। ছি ..ওভাবে কেঁদো না, লোকে কি বলবে।
এই কয়েকটি দিন কোন একটা বাঁধা ছিল।আজ সে বাঁধ ভেঙ্গে কথার বন্যা বয়ে গেল। আর তার শুরু টা চোখের জলে নাক মুখ ভাসিয়েই হল।
আমাদের পরিবারের অনন্যা ভাবী যখন প্রথম পা রাখলো। তখন তার বিশেষ কিছুই করার ছিল না। তার ওপড়ে বাবা তাকে তুলে এনেছে কোথাকার এক অজপাড়াগাঁয়ে থেকে। ২০০৯ সালের কথা।
আমার গ্রামের নামটি এখন ঠিক মনে নেই। রাঙামাটির কোন এক জায়গায় হবে। বেরাতে গিয়ে ওমন জায়গায় এমন সুন্দর এক নরীর সাথে বড় ভাইয়ের বিয়ে হয়ে যাবে।আমি কেন! ভাইয়া নিজেও ভাবেনি। তারপর পরের দিন রওনা হয়ে বাড়ি ফেরা। এরপর তাদের বাসরঘরে ভাবীর হাতধরে আমার সকাল অবধি গল্প করা। না না ভাইয়ার ওপড়ে কোন অন্যায় আমি করিনি সেদিন। বরং তার উল্টো! ভাইয়া সেদিন ভাবীকে একা রেখে তার ব্যবসার কাজে চলে গিয়েছিল।তখন আমার বোঝার ক্ষমতা ছিল বলেই রাত জেগে ছিলাম।
অচেনা জায়গা,অচেনা মানুষ।তার মাঝে দুটো ভীতু চোখ যেন আমার দিকে তাকিয়ে সেদিন আর্তনাদ করছিল। যদিও মুখ ফুটে কথা বের করতে বেশ সময় লেগেছিল তার। এখনো মাঝে মাঝে মনে পরে এক রাতের সেই ভীতু মেয়েটি ধিরে ধিরে আজকের এই বুদ্ধিমতী গিন্নী হয়ে ওঠা। সহজ হয়নি যাত্রা টা।
এক বারের কথা বলি।ভাবীর রান্নাবান্না ধরণ ছিল আলাদা, তবে রান্না সে পারতো।কিন্ত আশ্চর্য হলাম তার চা বানানো দেখে। তার আনাড়ির মত চায়ে, চিনিয়ে অধ ঘন্টা খানেক যে ব্যপারখানা সে করলো তাতে হাসি পেলেও সেদিন তাকে দেখিয়ে দেইনি। তাই রাগ করে প্রায় তিনদিন কথা বন্ধ। তার রাগ ভাঙাতে নিয়ে গিয়েছিলাম সিনেমা দেখতে।এর পর কত বার যে আমার হাত খরচের টাকা সিনেমার টিকিট কাটতে গেছে, তা আর বলতে হয়না।
আজ অনেকদিন পর হঠাৎ যেন সেই ভীতু মেয়েটিকে আবার দেখলাম। হাত বাড়িয়ে তার চোখের জল মুছতে মুছতে বললাম,
– এবার আর পালাবো না,এবার তোমার হাতে বাধাঁ পরলাম। লক্ষ্মীটি, এবার কান্না থামিয়ে বলোতো মেয়েটি কে?
অনন্যা ভাবী আমার পাশে সরে এল।কাঁধে মাথা রেখে বলল,
– মেঘলা কে মনে আছে তোমার? আজ সন্ধ্যায় আসবে ওড়া, ওড়া এলেই সাথে সাথেই তোমার বিয়ে দেবো আমি।
আমি কথা শুনে অবাক হয়ে বললাম,বল কি, মেঘলা! ও যে আমার হাঁটুর বয়সি মেয়ে।এই কান্ড কেন বাধালে বল তো !?
অনন্যা ভাবী এক রকম লাফিয়ে উঠলো। ঠোঁট বাকিয়ে বলল, হাটুর বয়সি হবে কেন! উনিশ বছর বয়স কম কিসে শুনি।
আমি হাসতে হাসতে বললাম।ওর বয়স কম নয় বরং আমার টা বেশি এবার যে ৩১ শে পা দিলাম। এরপর বেশ খানিকক্ষণ ধরে তর্কবিতর্ক চললো।এক
সময় সবাই চলে এলাম হোটেলে।
//////
তার পরের দিন।
আমি এমন একটা রুম চাইছিলাম যেন বারান্দা থেকে চোখ খুললেই সমুদ্র দেখবো। আর এমন জয়গা যেখানে যেমন খুশি ঘুরবো… এমন আর কি। তাই অবশেষে কক্সবাজার আসাটাই নিশ্চিত হলো। বিয়েটা ও এখানেই হবে। আগষ্টের ভ্যাপসা গরমে বাইরে থেকে এসেই ফ্রেস হতে বাথরুমে ডুকলাম।তার পর এসি ছেড়ে ঘুম।কতখন ঘুমিয়েছি জানি না,হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গলো অনন্যা ভাবীর ডাকে।আধবোঝা চোখে দেখলাম তার হাতে খাবারের প্লেট।সাথে আর কে একটা দাঁড়িয়ে আছে মনে হলো। ঘুম ঘুম ভাবটা তারিয়ে যখন উঠলাম তখন মনে পরলো দুপুরে খাবার কথাটা ভুলে মেরে দিয়েছি।
– দেখছো কখন খেতে হবে সেটাও আর একজনকে বলে দিতে হয়,সাধে কি আর বিয়ে করাতে এত তাড়াহুড়ো।
আমি ভাবির কথায় কান না দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালাম।মেয়েটা অনন্যা ভাবীর থেকে কিছু টা খাটো যদিও এখন তিন ইঞ্চি ব্ল্যাক হিল পরে আছে। ডান পায়ে পায়েল ও বাঁ হাতে একটা চার ইঞ্চির মত চওড়া একটা রুপালী ব্রেসলেট। চুলগুলো মাথায় ওড়না দিয়ে ঢাকা, পড়েন লাইট গ্রিন সালোয়ার।মেয়েটি মেঝের দিকে তাকিয়ে। আমি মেঘলা বলে ডাকতেই একবার চোখ তুলে তাকালো। যদিও মেঘলা আমার অচেনা কেউ নয়।বাবার বন্ধুর মেয়ে। দেখতে দুধে আলতা না হলেও ওকে সুন্দরী না বললে মিথ্যে বলা হয়। তবে আজ একটু অন্য রকম লাগছে ওকে।ঠিক কেন তা জানি না।
প্রথম একটু সন্দেহ ছিল, এ মেঘলা কি না। কিন্ত তা আর থাকলো না যখন আমার দিকে তাকালো।চেহারায় কিছু পরিবর্তন হয়েছে বটে। কিন্তু অভ্যেস মনে হয় হয়নি। আজও চোখে কাজল ও বাঁ ঠোঁটের নিচে একটা তিল একেছে।
– হয়েছে এতো দেখতে হবে না,আগে খেয়ে নাও তারপর সারা দিন বসে বসে দেখ,ও পালিয়ে যাচ্ছে না।
হঠাৎ ভাবীর কথায় মুখ নামিয়ে নিলাম।নিজে এমন ব্যবহার একটু লজ্জায় লাগছিল। আমি বাথরুম থেকে একটু ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম। অনন্যা ভাবী ও মেঘলা একটু দূরে মেঝেতে বসে আমার সুটকেসে কি একটা খুঁজে চলেছে।আমি জিগ্যেস করব ভাবছি ঠিক তখনই ভাবী একটা ডায়েরী ও ঝর্ণার ছবির ফ্রেমটা হাতে নিল। ওটা ঝর্ণার ডায়েরী।
– আহান আমি তোমার ডায়েরী টা নিচ্ছি এখন।
– কিন্তু ভাবী ওটা তো আমার ডায়েরী নয়। ওটা..
– আমি জানি আহান, তুমি জলদি খাওয়া শেষ করে নিচে যাও।
– কিন্ত কেন?
অনন্যা ভাবী মেঘলাকে হাতে ধরে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল।আমার প্রশ্নের জবাব পাওয়া হলো না।
//////
মেঘলা প্রথমবার সমুদ্র দেখছে। ও এই বিশালতার সামনে দাঁড়িয়ে কেমন করে নিজেকে প্রকাশ করে, সে নিয়ে আমার কৌতুহল উৎসাহ দুইই ছিল তুঙ্গে।মেয়েটি অনেকটা পাল্টে গেছে।অবশ্য এটাই তো স্বাভাবিক। পাঁচটি পার হয়েছে,পরিবর্তন না হয়ে উপায় কি। তবে ভাবী সে আমাকে এই কাজে পাঠাবে তা ভাবিনি।
খাওয়া শেষ করে যখন নিচে এলাম,তখন দেখি নিচে ভাবী ও মেঘলা দাঁড়িয়ে। কাছে যেতেই ভাবী মেঘলার হাতটি আমার হাতে দিয়ে বললো,
– মেঘলা সমুদ্র দেখেনি কখনো, ওকে নিয়ে একটু সমুদ্র ঘুরে এসো।
ভাবী তো এই বলেই সারা।সে মেঘলাকে আমার কাছে রেখে একরকম ছুটে চলে গেল। আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ সেদিকে তাকিয়ে রইলাম বাঁ হাতে ক্যামেরা ও ডান হাতে মেঘলার হাত ধরে।
এখন সমুদ্র সৈকতে আমি ক্যামেরা তাক করে দাঁড়িয়েছি মেঘলার মুখের উপর। কিন্তু যা ভেবেছিলাম তা হয়নি। মেয়েটির মধ্যে চঞ্চলতা কম বা নেই বললেই চলে। মেঘলা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে সমুদ্র দেখলো।তারপর হঠাৎই বলে বসলো,
– অনন্যা আপা আপনাকে ভালোবাসে এটাকি আপনি বোঝেন?
আমি কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে মেঘলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেঘলা আমার কাছে থেকে এগিয়ে গিয়ে ভেজা বালি পেরিয়ে ছোট ছোট ঢেউয়ের সংস্পর্শে গিয়ে দাঁড়ালো। তার এক হাতে হিল গুলো।অন্য হাতে বাতাসে উড়তে থাকা ওড়নাটা সামলে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে আমি নিজেকে সামলে এগিয়ে গিয়ে বললাম,
– মেঘলা, এই রকম ইয়ার্কি আমার পছন্দ নয়..
কথা শেষ হলো না,মেঘলা চোখ রাঙিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
– তাই! আমেকে দেখে আপনার মনে হয় আমি ইয়ার্কি করার মতো মেয়ে?
আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না,কিন্তু এটা কিভাবে হয়। কিছুই মেলাতে পারছি না। এদিকে মেঘলা বলে চলছে,
– আসলেই আপনি আস্ত একটা বাদর। একটা মেয়ে আপনাকে চোখের সামনে প্রতি নিয়ত ভালোবেসে চলেছে আর আপনি তা বোঝার চেষ্টাও করেননি কখনোই।
এটুকু বলে মেঘলা থেমে গেল। কিন্তু আমি যে এখনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। এর শুরু কখনো হল,কিভাবে হলে এমন অনেক প্রশ্ন জমাট বেধেঁ আমাকে ধিরে ধিরে অস্থির করে তুলছিল। আমি আরও কিছু শুনতে প্রস্তুতি নিলেও মেঘলা আর একটা কথায় বললো না।কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে এক সময় উঠে গেল। আমি একাকী দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম।
সন্ধ্যায় নামতেই ফোনে কল এলো অনন্যা ভাবীর। রিসিভ করতে সাহস হলো না।এই বিচ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সূর্যাস্ত হলো।হাতে ক্যামেরা ছিল। তবে ছবি তোলা হলো না। পুরোনো কথাগুলো মনে পরতে নাগলো। অনন্যা ভাবী বাড়ি আমার সাথে যতটুকু কথা বলতো আর কারো সাথেই বলতো না। এখন মনে পরে আমার সব অন্যায় আবদার গুলি তার নিঃশব্দে পূরণ করা। আমি বাবা বা ভাইয়ের কাছে কখনোই টাকা চাইনি।টাকার দরকার হলেই মা আর নয়তো ভাবী।। তারা টাকা কোথা থেকে দেবে একথা কখনো ভাবিনি। ভাববার প্রয়োজন হয়নি বলেই ভাবিনি। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে কখনোই না খেয়ে ঘুমাতে হয়নি।মা অসুস্থ হবার পর এই দ্বায়ীত্বে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভাবীকে হাত লাগাতে দেখেছি। সে রাত একটা হোক বা তিনটা। কিন্তু এর মাঝে কি কোন টান ছিল,খুবই বিশেষ কোন টান!ভাবতেও অবাক লাগছে এখন।আজ এতদিন পরে অন্য একটা মেয়ে আমার চোখে আঙুল দিয়ে এই কি দেখিয়ে গেল।এর কি কোন প্রয়োজন ছিল! নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে এখন। এখন কি করা উচিৎ! অনন্যা ভাবীকে সব বলে মনে ভারটা কমানো যায়।কিন্তু সে সাহস যে সঞ্চয় করতে পারছি না।
জার্মানির যাবার কিছুদিন পরেই শুনেছিলা ভাবী নাকি হাসপাতালে। তখন না জানলেও এখন মনে হচ্ছে হয়তো আমিই তার কারণ। তখন নিজের কয়েকজন বন্ধু ছাড়া বাড়ির কারোরই সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না। বেচারী জ্বরের ঘোর আমার নাম ধরে ডাকছিল শুনেছিলাম।ভেবেছিলাম আমিই তো তার একমাত বন্ধু বা সই,যার সাথে সে মনের কথা খুলে বলতে পারতো। কোন আবদার না পূরণ করলে আমার অভিমান ভাঙাতে ব্যস্ত হয়ে পরতো। কিন্তু তার মনের মাঝে কি চলছে কখনোই বোঝার চেষ্টা করিনি।
ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলাম রাস্তার দিকে। এমন সময় চোখে পড়লো কয়েকজন দাড়িয়ে চা পান করছে। যাক এতক্ষণে চা পাওয়া গেল। এককাপ চা হাতে অনন্যা ভাবীকে কল দিলাম। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছে না। আবার যখন ফোন করবো তখনই ভাবীর কল এলো।
– হ্যালো,ভাবী!
অপর দিকটা চুপচাপ। একটু অপেক্ষা করে বললাম, ভাবী মেঘলা তোমাকে সব বলেছে তাই না।....এই কথা গুলো তুমি নিজে বললে এতটা কষ্ট হতো না..
এইটুকু বলতেই অপর পাশে মেঘলার উত্তেজিত গলা শুনে থমকে গেলাম।
– আপনি জানেন আপনি কতটা সার্থপর! এখনও নিজের কথা ভাবছেন! আপনার সাথে কথা বলতেও আমার ঘ্রাণ হচ্ছে।
কথাটা শেষ করেই ফোনটা কেটে দিল। না আর রাস্তা রাস্তায় ঘুরলে হবে না।তাই কাপটা ডাস্টবিনে ফেলে একটা রিশকায় উঠলাম। আমার জীবনে আঘাত আসার তা এসেছে।আর কোন আঘাত সহ্য করা সম্ভব নয়। আমি স্বাভাবিক হতে চাই।আবারও হাসতে চাই। যা আছে কপালে দেখা যাবে পরে।
যখন হোটেলে ফিরলাম তখন খুব বেশি হলে রাত সাত কি আট বাজে। সোজাসুজি লিফট ধরে চারতলা উঠে 203 নম্ব�� রুমটি দিকে পা বাড়ালাম। রুমে কাছাকাছি আসতেই ভেতর থেকে সুমনের গিটারের সুরের সাথে অনন্যা ভাবী গলায় গান কানে ভেসে এলো....
তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে।
তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে।
তোমার ঝাউয়ের দোলে..
মর্মরিয়া ওঠে আমার দুঃখরাতের গান,
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান।
দরজা খুলে ভেততে ঢুকতেই ভাবী গান থামিয়ে এদিকে চাইলো। শুধু মেঘলা নয় ঘরের প্রতেকেই আমার এই হঠাৎ আগমোন সহজ ভাবে নেবে বলে মনে হলো না। আসলে আমি এদের কাছে এখন রসবোধের বস্তু মোটেই নোই। বিয়েটা আমার হলেও কেউই আমার সামনে ঠিক আনন্দে করতে চায় না। উল্টো আমাকে কিছুটা ভয় করে সবাই। এইসব দেখে মনে মনে হাসি পেল।এক সময় আনন্দ শব্দটি কেন্দ্র করে আমি থাকতাম,এখন এই অনন্দ শব্দটি এতো দূরে কেন আমার থেকে! যাই হোক ওদের আনন্দ মাটি হতে দিলাম না।এগিয়ে গিয়ে অনন্যা ভাবীর পাশে বসে সুমনের হাত থেকে গিটার নিয়ে প্রথমে টুংটাং ও পরে সুর ধরলাম।
আমাকে অনেক দিন পরে গিটার ধরতে শুনে সবচেয়ে বেশি খুশি যে, সে আমার মা। তারপরেই আসে ভাবী। মায়ের কানে কথাটা যেতেই মেঘলার আদর বাড়লো।এমন ঘটনায় মেঘলাও রিতিমত অবাক। তবে মোটের ওপড়ে সবাই খুশি।এবং মেঘলার ওপড়ে প্রসন্ন।কেন যেন সবার মনে ভাবনা হলো মেঘলাই এর কারণ। অবশ্য ভাবনাটি খুব একটা ভুল নয়।
রাত প্রায় শেষের দিকে আমি ছাদে উঠবো বলে ভাবলাম।লিফটের জন্যে অপেক্ষা করতে ইচ্ছে হলো না। তাই সিঁড়ি ধরলাম।আমার রুমটি উপড়ের তলায় সবার থেকে আলাদা।তার ওপরে পাসপোর্ট সহ সকল কাগজ পত্র অনন্যা ভাবীর পাহাড়ায়। তাই খুব বিশেষ চিন্তা কারো ছিল না।আর আজকে ঘটনার পরে তা একদম বিলুপ্ত প্রায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং আমি রাতে কোথায় যাচ্ছি তার দেখার কেউ নেই।
তবে এই ভাবনা ভুল প্রমাণিত করে ছাদে শাড়ির আঁচল উড়িয়ে অনন্যা ভাবী দাঁড়িয়ে ছিল। তার একটু দূরে আরও কয়েকজন মেয়ে এক সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আমি দু-পা এগিয়ে আবারও পেছন ফিরে নিচে নামতে লাগলাম।
কিছুটা নামতেই পেছন থেকে কেউ দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো। মনে হয় আমার চমকে যাওয়া উচিৎ ছিল।কিন্তু মনে যে ইতিমধ্যেই সজাগ হয়ে আছে।
পেছন ফিরে থাকলেও বুঝলাম ভাবী কাঁদতে কাঁদতে আমির পিঠ ভিজিয়ে দেবে এখনি।আমি পেছন ফিরে তাকে বুকে জড়িয়ে কোমল স্বরে বললাম,
– কিছু বলতে চাইলে এই শেষ সুযোগ।
– আবার বুঝি পালানোর মতলব করছো
মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে কথাগুলো বলল ভাবী।তার পর ধীরগতিতে নিচে নামতে লাগলো। কেমন একটা রাগের অনুভূতি হচ্ছিল। এগিয়ে ঘগিয়ে তার ডান কব্জিতে বাঁ হাতে চেঁপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে ��েতে লাগলাম।আমার উত্তর দরকার,কিন্তি সহজ ভাবে তা বের করা সম্ভব নয়। তার মধ্যে যদি বন্দিনী ছাড়া পেতে না চায় তবে আর কে আটকায়।সোজা আমার রুমে ঢুকে ভাবীকে বেডে বসিয়ে,আমি বসলাম তার পায়ের কাছে মেঝেতে। মেঝেতে বসেই বুঝলাম এ নারির মুখে সহজে কথা ফুটবে না,কাঠ হয়ে বসে চোখের জলে গাল দুটো বাসিয়ে চলেছে।
– একটা সত্য কথা বলো তো,আজ যদি পালাই তবে আমার সঙ্গী হবে তুমি?
ভাবী হটাৎ চমকে আমার দিকে তাকালো,তারপরেই ব্যাকুল হয়ে মেঝেতে নেমে আমাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
– তুমি কথা দিয়েছো আহান ,এবার কোথাও গেলে ফিরে এসে আমার এই মুখ দেখতে হবে না তোমাকে।
– শস্...লক্ষ্মীটি এমন করে বলো না।
কথাটা বলেই আমি ভাবী দুই হাতে ও কপালে চুমু খেলাম, তার অশ্রু মুছে দিয়ে খাটে হেলান দিয়ে পা দুটো সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বসলাম।এবং ভাবীর মাথাটা টেনে এনে তাকে শুয়িয়ে দিলাম আমার পায়ের ওপড়ে।দু-চোখ বুঝে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম,
– তাহলে নিজের ভালোবাসাকে অনের হাতে তুলে দেবে?
– যদি এতে তার ভালো হয়,সে ��ুখে থাকে তবে কেন দেব না
– তোমার মনে হয় এতে আমি সুখী হবো?
– কেন হবে না, মেঘলা খুব ভালো মেয়ে ....
– শসস্..আর বলো না..আজ ওর কথা থাক।তোমার কথা বলো,আমি অনেক অন্যায় করেছি তোমার সাথে। সেই আভিযোগ গুলো আজকে শুনতে চাই আমি,কোন কিছুই গোপন রেখো না আর। শুধু এটুকু দয়া কর আমায়।
মনে হয় চোখে দুটো আদ্র হয়ে এসেছিল,ভাবী উঠে বসে আমার গালে হাত দিয়ে তার মুখটা খুব কাছে টেনে নিল। তারপর দু জোড়া ঠোঁটের সাথে দুজোড়া চৈখের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।যখন ঠোঁটের বাঁধন মুক্ত হলো,তখন ভাবীর গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট দুঠোই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে। আমার চোখের জল মুছতে মুছতে ভাবী বলল,
– সেই গুলো আমারই থাক,যখন তুমি ছিলে না তখন ওই স্মৃতি গুলো বুকে আকড়ে বেচেঁ ছিলাম। ওগুলো ছিনিয়ে নিও না।
আমি কিছু বলতে চাইছিলাম কিন্তু ভাবি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে থামিয়ে বলল, আর কোন কথা নয়।যদি সত্যিই কিছুই দিতে চাও তবে এটুকুই চাইবো, আর একা ছেড়ে যেওনা। আমি কাছে থেকে তোমায় সুখী দেখতে চাই। অনেক সুখ তুমি আমায় দিয়েছো এবারের আমাকে তোমার একটু পাশে থেকে ��কটু সেবা করতে দায়,তুমি সুখী হও, এর চেয়ে বেশি আমার আর কিছুই চাই না।
কাঁচের জানালা ভেদ করে সোনালী রোদের আলো প্রবেশ করতেই অন্ধকার রুমে কিছুটা আলো ছেয়ে পরলো।আমি নিঃশব্দে বসে তার চলে যাওয়া দেখলাম।.... আজকেও কোন প্রশ্ন নয়।আসলে প্রতেকটি গল্পই অনেক প্রশ্ন রেখে যায়, সে সমাপ্ত হোক বা না হোক।তবে কিছু প্রশ্নের উত্তর অজানা থাকাই ভালো।
আমি একটি ক্যানন এর ক্যামেরা হাতে তখন ফোকাস করতে চাইছিলাম ঘোড়ার দিকে, অথবা সমুদ্রের দিকে, অথবা ঘোড়াসহ সমুদ্রের দিকে।
এটা কক্সবাজারের বেশ নির্জন একটা স্থান৷ লোকজন কম, তাই বলে নেই এমনটা নয়।
আমি ছবির ফ্রেমে শুধু ঘোড়া আর সমুদ্রই চাইছিলাম,আর খালি সেখানে একটা পাগলাটে ধরনের লম্বা লোক সবুজ ফুলহাতা জামা আর খয়েরি ফুলপ্যান্ট পরা… সে বারবার চলে আসছিল। একটু টলছিল ওই লোকটা। এতটাই রোগা যে মনে হচ্ছিল সমুদ্রের হাওয়ায় ও টাল সামলাতে পারছে না… অমনই টলতে টলতে একসময় সে ডিফ্রেম হল। আর, আমি ছবিখানি তুলতে পারলাম। এত সময় নিয়ে তুলেছিলাম ছবিটি যে বাড়ির লোকজন অধৈর্য্য হচ্ছিল, তবু, শেষমেশ সে ছবি উঠল। বাড়ির বড়রা পরে ছবি দেখে খুব ঠাট্টাকরে বলেছিলেন
– বাহ্.. বেশ দার্শনিক ছবি
আমারপাশে দাড়িয়ে অনন্যা ভাবি আবার সচেতন পরামর্শ দিল,
– এমন একলা একলা ভাবের ছবি তোলো কেন! দেখে কেমন দু:খু হয়!...আচ্ছা তোমার কি হয়েছে বলো তো?
আমি ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলাম।তারপর তার শান্ত মুখের দিকে থেকে মুখ সরিয়ে ক্যামেরার চোখ রেখে শান্ত স্বরে বললাম,
– আমার আবার কি হবে! তুমি ভাইয়ের কাছে যাও তো,কেমন একা বসে আছে, দেখতে খারাপ দেখায়।
ভাবির বোধহয় যাওয়া��� ইচ্ছে ছিল না। সে তার বড় বড় চোখ গুলো সংকোচিত করে আমার দিকে চেয়ে রইলো।
আমার বড় পরিবারের এই একটি মানুষকে কেউ ফাঁকি দিতে আজ পর্যন্ত সফল হয়েছে কি না,তা আমি সঠিক ভাবে জানি না। তাই ভাবিকে সেখানে রেখে আমি সরে পরলাম।
সময়টা ২০২৩, এক বর্ষার বিকালে সাগরের পারে ক্যামেরা হাতে খালি পায়ে ভেজা বালির ওপড়ে হাটছি। আর মনে মনে এমনি এক বর্ষার দিনে ঘটে যাওয়া আমাদের একটি ঘটনার ভয়াবহতাকে ভুলতে চাইছিলাম।দাঁড়াও এখানে বোধকরি "আমাদের" শব্দটা ব্যবহার করা ঠিক হল না, কারণ এখন আমাদের বিচ্ছেদ হয়েছে প্রায় সাত বছর হলো। তো সে যাইহোক, ঠিক এমনি একদিনে তখনকার প্রিয়জনকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি গেছে।
তিন বছরের প্রেমের পর আমাদের বিয়ের দিনেই সে মারা গেল।আর এই ঘটনার প্রায় সপ্তাহ খানেক পরেই আমি ঠিক করলাম বিদেশ পারি জমাবো। হলোও তাই, মাস দুই একের মধ্যেই আমি জার্মানির একটা ফ্লাইটে উঠে পরলাম।এরপর..সে কথা না হয় নাই বা বললাম,নিজের দুঃখ ভ্রমণ কাহিনী ছড়িয়ে দিয়ে লাভের কিছু তো নেই। উল্টো মানুষের জার্মানির সম্পর্কে ভয় তৈরি হবে
আজ সাত বছর পরে আবারও দেশে। কারণটি বিয়ে! আমাকে ভুল বুঝতে পারো। কিন্তু এই বিয়েতে আমার মত নেই। এমনকি আমি যদি আগে জানতাম, তবে দেশের মাটিতে পা ফেলতাম না।তবে ওই যে বললাম, পরিবারের সবাইকে ফাঁকি দিলেও অনন্যা ভাবীকে ফাঁকি দেওয়া খুবই কঠিন কাজ।
হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা এগোতেই পেছন থেকে অনন্যা ভাবী ডাকলো,
– আহান দাঁড়ায় একটু !!
একটু চমকে গিয়েছিল আমি। আসলে ভাবতে ভাবতে একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম কিনা তাই। পেছনে ফিরে দেখলাম, অনন্যা ভাবী নিজের খোলা ও অবাধ্য চুলগুলোকে ডান হাতে শাসন করতে করতে এগিয়ে আসছে। বাতাসে তার হালকা নীল রঙের আঁচল খানি উড়ে যেতে চাইছে বারবার। ইচ্ছে না থাকলেও চোখ নামিয়ে নিতে নিতে তার খালি পায়ে পরা নূপুরের দিকে চোখ গেল।তারপর চোখ ফেরাতেই আবারও চোখের সামনে সমুদ্র,দূরে দুই একটা সাম্পান।
ঝর্ণার সমুদ্র খুব পছন্দ ছিল। না, আবারও অতিতে চলে গেল মনটা। তবে বেশি দূর যাওয়া হলো না।ফিরে আসতে হলো ভাবীর ডাকে।
– আহান! কোথাও বসবে চলো।
আমি হাসি মুখে ভাবীর দিকে তাকিয়ে বললাম, না, আমার সাথে কথা বলতে হলে হাঁটতে হবে।
বলেই আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম।মনে মনে ভাবলাম বোধকরি হাঁটতে হবে ভেবে ফিরে যাবে আবার। আমি যতটুকু জানি অনন্যা ভাবী হাঁটতে ঠিক পছন্দ করে না। কিন্তু আমাকে অবাক হতে হলো। সে আমার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় আমার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। আমি একটু পর পর তার দিকে তাকিয়ে ���েখছিলাম।তার মুখে বিরক্তি, ও অস্থিরতার ছাপ স্পষ্ট।এক সময় আর থাকতে না পের বলেই ফেললাম।
– কোথায় বসবে বল?
আমার কথাটা তার কানে যাওয়া মাত্রই সে ভেজা বালির ওপড়ে দুই হাটুতে হাতরেখে বসে পড়লো।
– আহা..ওকি কর! ভিজে যাবে যে।
– ও চিন্তা তোমার না করলেও চলবে,এখন আমার পাশে বসে পরতো দেখি।
আমার না বলার উপায় নেই।সুতরাং আমাকেও বসতে হলো।আর তার সাথে সাথেই একটা ঢেউ এসে আমার পা ছাড়িয়ে একদম পাছা অবধি ভিজিয়ে দিল। অবশ্য এতে আমার পাশে বসা রমনীর কোন বিকার নেই। সে মুখে মিষ্টি স্বরখানি যতটা সম্ভব গম্ভীর করে বলল,
– তো বিয়েটা করছো এবার, শেষমেষ পালাবে না তো!
আমি একটু হেসে বললাম, তুমি পালাতে দিলে তবে না পালাবো। সে সুযোগ পাচ্ছি কোথায় বল। আমার পাসপোর্ট নিয়েও তো তোমার শান্তি নেই।এখনো চোখে চোখে রাখছো,পালানোর উপায় কি আমার বল!
আমি কথা শেষ করে দেখলা ভাবী তার হাটুতে মাথা কাত করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।তবে অবাক হলাম তার চোখে অশ্রু দেখ���।
কেনো যেন মনে হলে তার অশ্রু কারণটি আমি। যার সাথে দিনের বেশিরভাগ সময় কাটতো। আজ পাঁচ বছর পরে এই প্রথম কথা।তাও আমার মনটি পালাই পালাই করছে।
– মনে আছে আহান আমি যখন নতুন এসেছিলাম তোমাদের বাড়িতে,আমি কাঁদছিল বলে তুমি পাশে বসে ছিলে। তোমার ভাইকে ঘরে ঢুকতে দাওনি বা যখন হাসপাতালে শুয়েছিলাম আমি,তোমার ভাই সেদিন দেশের বাইরে। তুমি বলেছিলে কখনো ছেড়ে যাবে না।
আমি তাকিয়েই ছিলাম তার মুখের দিকে। বলতে বলতে এক সময় গাল ফুলিয়ে কাঁদতে বসে গেল।
– আরে দেখ দেখি কি কান্ড, কাঁদছো কেন। ছি ..ওভাবে কেঁদো না, লোকে কি বলবে।
এই কয়েকটি দিন কোন একটা বাঁধা ছিল।আজ সে বাঁধ ভেঙ্গে কথার বন্যা বয়ে গেল। আর তার শুরু টা চোখের জলে নাক মুখ ভাসিয়েই হল।
আমাদের পরিবারের অনন্যা ভাবী যখন প্রথম পা রাখলো। তখন তার বিশেষ কিছুই করার ছিল না। তার ওপড়ে বাবা তাকে তুলে এনেছে কোথাকার এক অজপাড়াগাঁয়ে থেকে। ২০০৯ সালের কথা।
আমার গ্রামের নামটি এখন ঠিক মনে নেই। রাঙামাটির কোন এক জায়গায় হবে। বেরাতে গিয়ে ওমন জায়গায় এমন সুন্দর এক নরীর সাথে বড় ভাইয়ের বিয়ে হয়ে যাবে।আমি কেন! ভাইয়া নিজেও ভাবেনি। তারপর পরের দিন রওনা হয়ে বাড়ি ফেরা। এরপর তাদের বাসরঘরে ভাবীর হাতধরে আমার সকাল অবধি গল্প করা। না না ভাইয়ার ওপড়ে কোন অন্যায় আমি করিনি সেদিন। বরং তার উল্টো! ভাইয়া সেদিন ভাবীকে একা রেখে তার ব্যবসার কাজে চলে গিয়েছিল।তখন আমার বোঝার ক্ষমতা ছিল বলেই রাত জেগে ছিলাম।
অচেনা জায়গা,অচেনা মানুষ।তার মাঝে দুটো ভীতু চোখ যেন আমার দিকে তাকিয়ে সেদিন আর্তনাদ করছিল। যদিও মুখ ফুটে কথা বের করতে বেশ সময় লেগেছিল তার। এখনো মাঝে মাঝে মনে পরে এক রাতের সেই ভীতু মেয়েটি ধিরে ধিরে আজকের এই বুদ্ধিমতী গিন্নী হয়ে ওঠা। সহজ হয়নি যাত্রা টা।
এক বারের কথা বলি।ভাবীর রান্নাবান্না ধরণ ছিল আলাদা, তবে রান্না সে পারতো।কিন্ত আশ্চর্য হলাম তার চা বানানো দেখে। তার আনাড়ির মত চায়ে, চিনিয়ে অধ ঘন্টা খানেক যে ব্যপারখানা সে করলো তাতে হাসি পেলেও সেদিন তাকে দেখিয়ে দেইনি। তাই রাগ করে প্রায় তিনদিন কথা বন্ধ। তার রাগ ভাঙাতে নিয়ে গিয়েছিলাম সিনেমা দেখতে।এর পর কত বার যে আমার হাত খরচের টাকা সিনেমার টিকিট কাটতে গেছে, তা আর বলতে হয়না।
আজ অনেকদিন পর হঠাৎ যেন সেই ভীতু মেয়েটিকে আবার দেখলাম। হাত বাড়িয়ে তার চোখের জল মুছতে মুছতে বললাম,
– এবার আর পালাবো না,এবার তোমার হাতে বাধাঁ পরলাম। লক্ষ্মীটি, এবার কান্না থামিয়ে বলোতো মেয়েটি কে?
অনন্যা ভাবী আমার পাশে সরে এল।কাঁধে মাথা রেখে বলল,
– মেঘলা কে মনে আছে তোমার? আজ সন্ধ্যায় আসবে ওড়া, ওড়া এলেই সাথে সাথেই তোমার বিয়ে দেবো আমি।
আমি কথা শুনে অবাক হয়ে বললাম,বল কি, মেঘলা! ও যে আমার হাঁটুর বয়সি মেয়ে।এই কান্ড কেন বাধালে বল তো !?
অনন্যা ভাবী এক রকম লাফিয়ে উঠলো। ঠোঁট বাকিয়ে বলল, হাটুর বয়সি হবে কেন! উনিশ বছর বয়স কম কিসে শুনি।
আমি হাসতে হাসতে বললাম।ওর বয়স কম নয় বরং আমার টা বেশি এবার যে ৩১ শে পা দিলাম। এরপর বেশ খানিকক্ষণ ধরে তর্কবিতর্ক চললো।এক
সময় সবাই চলে এলাম হোটেলে।
//////
তার পরের দিন।
আমি এমন একটা রুম চাইছিলাম যেন বারান্দা থেকে চোখ খুললেই সমুদ্র দেখবো। আর এমন জয়গা যেখানে যেমন খুশি ঘুরবো… এমন আর কি। তাই অবশেষে কক্সবাজার আসাটাই নিশ্চিত হলো। বিয়েটা ও এখানেই হবে। আগষ্টের ভ্যাপসা গরমে বাইরে থেকে এসেই ফ্রেস হতে বাথরুমে ডুকলাম।তার পর এসি ছেড়ে ঘুম।কতখন ঘুমিয়েছি জানি না,হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গলো অনন্যা ভাবীর ডাকে।আধবোঝা চোখে দেখলাম তার হাতে খাবারের প্লেট।সাথে আর কে একটা দাঁড়িয়ে আছে মনে হলো। ঘুম ঘুম ভাবটা তারিয়ে যখন উঠলাম তখন মনে পরলো দুপুরে খাবার কথাটা ভুলে মেরে দিয়েছি।
– দেখছো কখন খেতে হবে সেটাও আর একজনকে বলে দিতে হয়,সাধে কি আর বিয়ে করাতে এত তাড়াহুড়ো।
আমি ভাবির কথায় কান না দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালাম।মেয়েটা অনন্যা ভাবীর থেকে কিছু টা খাটো যদিও এখন তিন ইঞ্চি ব্ল্যাক হিল পরে আছে। ডান পায়ে পায়েল ও বাঁ হাতে একটা চার ইঞ্চির মত চওড়া একটা রুপালী ব্রেসলেট। চুলগুলো মাথায় ওড়না দিয়ে ঢাকা, পড়েন লাইট গ্রিন সালোয়ার।মেয়েটি মেঝের দিকে তাকিয়ে। আমি মেঘলা বলে ডাকতেই একবার চোখ তুলে তাকালো। যদিও মেঘলা আমার অচেনা কেউ নয়।বাবার বন্ধুর মেয়ে। দেখতে দুধে আলতা না হলেও ওকে সুন্দরী না বললে মিথ্যে বলা হয়। তবে আজ একটু অন্য রকম লাগছে ওকে।ঠিক কেন তা জানি না।
প্রথম একটু সন্দেহ ছিল, এ মেঘলা কি না। কিন্ত তা আর থাকলো না যখন আমার দিকে তাকালো।চেহারায় কিছু পরিবর্তন হয়েছে বটে। কিন্তু অভ্যেস মনে হয় হয়নি। আজও চোখে কাজল ও বাঁ ঠোঁটের নিচে একটা তিল একেছে।
– হয়েছে এতো দেখতে হবে না,আগে খেয়ে নাও তারপর সারা দিন বসে বসে দেখ,ও পালিয়ে যাচ্ছে না।
হঠাৎ ভাবীর কথায় মুখ নামিয়ে নিলাম।নিজে এমন ব্যবহার একটু লজ্জায় লাগছিল। আমি বাথরুম থেকে একটু ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম। অনন্যা ভাবী ও মেঘলা একটু দূরে মেঝেতে বসে আমার সুটকেসে কি একটা খুঁজে চলেছে।আমি জিগ্যেস করব ভাবছি ঠিক তখনই ভাবী একটা ডায়েরী ও ঝর্ণার ছবির ফ্রেমটা হাতে নিল। ওটা ঝর্ণার ডায়েরী।
– আহান আমি তোমার ডায়েরী টা নিচ্ছি এখন।
– কিন্তু ভাবী ওটা তো আমার ডায়েরী নয়। ওটা..
– আমি জানি আহান, তুমি জলদি খাওয়া শেষ করে নিচে যাও।
– কিন্ত কেন?
অনন্যা ভাবী মেঘলাকে হাতে ধরে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল।আমার প্রশ্নের জবাব পাওয়া হলো না।
//////
মেঘলা প্রথমবার সমুদ্র দেখছে। ও এই বিশালতার সামনে দাঁড়িয়ে কেমন করে নিজেকে প্রকাশ করে, সে নিয়ে আমার কৌতুহল উৎসাহ দুইই ছিল তুঙ্গে।মেয়েটি অনেকটা পাল্টে গেছে।অবশ্য এটাই তো স্বাভাবিক। পাঁচটি পার হয়েছে,পরিবর্তন না হয়ে উপায় কি। তবে ভাবী সে আমাকে এই কাজে পাঠাবে তা ভাবিনি।
খাওয়া শেষ করে যখন নিচে এলাম,তখন দেখি নিচে ভাবী ও মেঘলা দাঁড়িয়ে। কাছে যেতেই ভাবী মেঘলার হাতটি আমার হাতে দিয়ে বললো,
– মেঘলা সমুদ্র দেখেনি কখনো, ওকে নিয়ে একটু সমুদ্র ঘুরে এসো।
ভাবী তো এই বলেই সারা।সে মেঘলাকে আমার কাছে রেখে একরকম ছুটে চলে গেল। আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ সেদিকে তাকিয়ে রইলাম বাঁ হাতে ক্যামেরা ও ডান হাতে মেঘলার হাত ধরে।
এখন সমুদ্র সৈকতে আমি ক্যামেরা তাক করে দাঁড়িয়েছি মেঘলার মুখের উপর। কিন্তু যা ভেবেছিলাম তা হয়নি। মেয়েটির মধ্যে চঞ্চলতা কম বা নেই বললেই চলে। মেঘলা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে সমুদ্র দেখলো।তারপর হঠাৎই বলে বসলো,
– অনন্যা আপা আপনাকে ভালোবাসে এটাকি আপনি বোঝেন?
আমি কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে মেঘলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেঘলা আমার কাছে থেকে এগিয়ে গিয়ে ভেজা বালি পেরিয়ে ছোট ছোট ঢেউয়ের সংস্পর্শে গিয়ে দাঁড়ালো। তার এক হাতে হিল গুলো।অন্য হাতে বাতাসে উড়তে থাকা ওড়নাটা সামলে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে আমি নিজেকে সামলে এগিয়ে গিয়ে বললাম,
– মেঘলা, এই রকম ইয়ার্কি আমার পছন্দ নয়..
কথা শেষ হলো না,মেঘলা চোখ রাঙিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
– তাই! আমেকে দেখে আপনার মনে হয় আমি ইয়ার্কি করার মতো মেয়ে?
আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না,কিন্তু এটা কিভাবে হয়। কিছুই মেলাতে পারছি না। এদিকে মেঘলা বলে চলছে,
– আসলেই আপনি আস্ত একটা বাদর। একটা মেয়ে আপনাকে চোখের সামনে প্রতি নিয়ত ভালোবেসে চলেছে আর আপনি তা বোঝার চেষ্টাও করেননি কখনোই।
এটুকু বলে মেঘলা থেমে গেল। কিন্তু আমি যে এখনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। এর শুরু কখনো হল,কিভাবে হলে এমন অনেক প্রশ্ন জমাট বেধেঁ আমাকে ধিরে ধিরে অস্থির করে তুলছিল। আমি আরও কিছু শুনতে প্রস্তুতি নিলেও মেঘলা আর একটা কথায় বললো না।কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে এক সময় উঠে গেল। আমি একাকী দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম।
সন্ধ্যায় নামতেই ফোনে কল এলো অনন্যা ভাবীর। রিসিভ করতে সাহস হলো না।এই বিচ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সূর্যাস্ত হলো।হাতে ক্যামেরা ছিল। তবে ছবি তোলা হলো না। পুরোনো কথাগুলো মনে পরতে নাগলো। অনন্যা ভাবী বাড়ি আমার সাথে যতটুকু কথা বলতো আর কারো সাথেই বলতো না। এখন মনে পরে আমার সব অন্যায় আবদার গুলি তার নিঃশব্দে পূরণ করা। আমি বাবা বা ভাইয়ের কাছে কখনোই টাকা চাইনি।টাকার দরকার হলেই মা আর নয়তো ভাবী।। তারা টাকা কোথা থেকে দেবে একথা কখনো ভাবিনি। ভাববার প্রয়োজন হয়নি বলেই ভাবিনি। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে কখনোই না খেয়ে ঘুমাতে হয়নি।মা অসুস্থ হবার পর এই দ্বায়ীত্বে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভাবীকে হাত লাগাতে দেখেছি। সে রাত একটা হোক বা তিনটা। কিন্তু এর মাঝে কি কোন টান ছিল,খুবই বিশেষ কোন টান!ভাবতেও অবাক লাগছে এখন।আজ এতদিন পরে অন্য একটা মেয়ে আমার চোখে আঙুল দিয়ে এই কি দেখিয়ে গেল।এর কি কোন প্রয়োজন ছিল! নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে এখন। এখন কি করা উচিৎ! অনন্যা ভাবীকে সব বলে মনে ভারটা কমানো যায়।কিন্তু সে সাহস যে সঞ্চয় করতে পারছি না।
জার্মানির যাবার কিছুদিন পরেই শুনেছিলা ভাবী নাকি হাসপাতালে। তখন না জানলেও এখন মনে হচ্ছে হয়তো আমিই তার কারণ। তখন নিজের কয়েকজন বন্ধু ছাড়া বাড়ির কারোরই সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না। বেচারী জ্বরের ঘোর আমার নাম ধরে ডাকছিল শুনেছিলাম।ভেবেছিলাম আমিই তো তার একমাত বন্ধু বা সই,যার সাথে সে মনের কথা খুলে বলতে পারতো। কোন আবদার না পূরণ করলে আমার অভিমান ভাঙাতে ব্যস্ত হয়ে পরতো। কিন্তু তার মনের মাঝে কি চলছে কখনোই বোঝার চেষ্টা করিনি।
ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলাম রাস্তার দিকে। এমন সময় চোখে পড়লো কয়েকজন দাড়িয়ে চা পান করছে। যাক এতক্ষণে চা পাওয়া গেল। এককাপ চা হাতে অনন্যা ভাবীকে কল দিলাম। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছে না। আবার যখন ফোন করবো তখনই ভাবীর কল এলো।
– হ্যালো,ভাবী!
অপর দিকটা চুপচাপ। একটু অপেক্ষা করে বললাম, ভাবী মেঘলা তোমাকে সব বলেছে তাই না।....এই কথা গুলো তুমি নিজে বললে এতটা কষ্ট হতো না..
এইটুকু বলতেই অপর পাশে মেঘলার উত্তেজিত গলা শুনে থমকে গেলাম।
– আপনি জানেন আপনি কতটা সার্থপর! এখনও নিজের কথা ভাবছেন! আপনার সাথে কথা বলতেও আমার ঘ্রাণ হচ্ছে।
কথাটা শেষ করেই ফোনটা কেটে দিল। না আর রাস্তা রাস্তায় ঘুরলে হবে না।তাই কাপটা ডাস্টবিনে ফেলে একটা রিশকায় উঠলাম। আমার জীবনে আঘাত আসার তা এসেছে।আর কোন আঘাত সহ্য করা সম্ভব নয়। আমি স্বাভাবিক হতে চাই।আবারও হাসতে চাই। যা আছে কপালে দেখা যাবে পরে।
যখন হোটেলে ফিরলাম তখন খুব বেশি হলে রাত সাত কি আট বাজে। সোজাসুজি লিফট ধরে চারতলা উঠে 203 নম্ব�� রুমটি দিকে পা বাড়ালাম। রুমে কাছাকাছি আসতেই ভেতর থেকে সুমনের গিটারের সুরের সাথে অনন্যা ভাবী গলায় গান কানে ভেসে এলো....
তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে।
তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে।
তোমার ঝাউয়ের দোলে..
মর্মরিয়া ওঠে আমার দুঃখরাতের গান,
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান।
দরজা খুলে ভেততে ঢুকতেই ভাবী গান থামিয়ে এদিকে চাইলো। শুধু মেঘলা নয় ঘরের প্রতেকেই আমার এই হঠাৎ আগমোন সহজ ভাবে নেবে বলে মনে হলো না। আসলে আমি এদের কাছে এখন রসবোধের বস্তু মোটেই নোই। বিয়েটা আমার হলেও কেউই আমার সামনে ঠিক আনন্দে করতে চায় না। উল্টো আমাকে কিছুটা ভয় করে সবাই। এইসব দেখে মনে মনে হাসি পেল।এক সময় আনন্দ শব্দটি কেন্দ্র করে আমি থাকতাম,এখন এই অনন্দ শব্দটি এতো দূরে কেন আমার থেকে! যাই হোক ওদের আনন্দ মাটি হতে দিলাম না।এগিয়ে গিয়ে অনন্যা ভাবীর পাশে বসে সুমনের হাত থেকে গিটার নিয়ে প্রথমে টুংটাং ও পরে সুর ধরলাম।
আমাকে অনেক দিন পরে গিটার ধরতে শুনে সবচেয়ে বেশি খুশি যে, সে আমার মা। তারপরেই আসে ভাবী। মায়ের কানে কথাটা যেতেই মেঘলার আদর বাড়লো।এমন ঘটনায় মেঘলাও রিতিমত অবাক। তবে মোটের ওপড়ে সবাই খুশি।এবং মেঘলার ওপড়ে প্রসন্ন।কেন যেন সবার মনে ভাবনা হলো মেঘলাই এর কারণ। অবশ্য ভাবনাটি খুব একটা ভুল নয়।
রাত প্রায় শেষের দিকে আমি ছাদে উঠবো বলে ভাবলাম।লিফটের জন্যে অপেক্ষা করতে ইচ্ছে হলো না। তাই সিঁড়ি ধরলাম।আমার রুমটি উপড়ের তলায় সবার থেকে আলাদা।তার ওপরে পাসপোর্ট সহ সকল কাগজ পত্র অনন্যা ভাবীর পাহাড়ায়। তাই খুব বিশেষ চিন্তা কারো ছিল না।আর আজকে ঘটনার পরে তা একদম বিলুপ্ত প্রায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং আমি রাতে কোথায় যাচ্ছি তার দেখার কেউ নেই।
তবে এই ভাবনা ভুল প্রমাণিত করে ছাদে শাড়ির আঁচল উড়িয়ে অনন্যা ভাবী দাঁড়িয়ে ছিল। তার একটু দূরে আরও কয়েকজন মেয়ে এক সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আমি দু-পা এগিয়ে আবারও পেছন ফিরে নিচে নামতে লাগলাম।
কিছুটা নামতেই পেছন থেকে কেউ দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো। মনে হয় আমার চমকে যাওয়া উচিৎ ছিল।কিন্তু মনে যে ইতিমধ্যেই সজাগ হয়ে আছে।
পেছন ফিরে থাকলেও বুঝলাম ভাবী কাঁদতে কাঁদতে আমির পিঠ ভিজিয়ে দেবে এখনি।আমি পেছন ফিরে তাকে বুকে জড়িয়ে কোমল স্বরে বললাম,
– কিছু বলতে চাইলে এই শেষ সুযোগ।
– আবার বুঝি পালানোর মতলব করছো
মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে কথাগুলো বলল ভাবী।তার পর ধীরগতিতে নিচে নামতে লাগলো। কেমন একটা রাগের অনুভূতি হচ্ছিল। এগিয়ে ঘগিয়ে তার ডান কব্জিতে বাঁ হাতে চেঁপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে ��েতে লাগলাম।আমার উত্তর দরকার,কিন্তি সহজ ভাবে তা বের করা সম্ভব নয়। তার মধ্যে যদি বন্দিনী ছাড়া পেতে না চায় তবে আর কে আটকায়।সোজা আমার রুমে ঢুকে ভাবীকে বেডে বসিয়ে,আমি বসলাম তার পায়ের কাছে মেঝেতে। মেঝেতে বসেই বুঝলাম এ নারির মুখে সহজে কথা ফুটবে না,কাঠ হয়ে বসে চোখের জলে গাল দুটো বাসিয়ে চলেছে।
– একটা সত্য কথা বলো তো,আজ যদি পালাই তবে আমার সঙ্গী হবে তুমি?
ভাবী হটাৎ চমকে আমার দিকে তাকালো,তারপরেই ব্যাকুল হয়ে মেঝেতে নেমে আমাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
– তুমি কথা দিয়েছো আহান ,এবার কোথাও গেলে ফিরে এসে আমার এই মুখ দেখতে হবে না তোমাকে।
– শস্...লক্ষ্মীটি এমন করে বলো না।
কথাটা বলেই আমি ভাবী দুই হাতে ও কপালে চুমু খেলাম, তার অশ্রু মুছে দিয়ে খাটে হেলান দিয়ে পা দুটো সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বসলাম।এবং ভাবীর মাথাটা টেনে এনে তাকে শুয়িয়ে দিলাম আমার পায়ের ওপড়ে।দু-চোখ বুঝে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম,
– তাহলে নিজের ভালোবাসাকে অনের হাতে তুলে দেবে?
– যদি এতে তার ভালো হয়,সে ��ুখে থাকে তবে কেন দেব না
– তোমার মনে হয় এতে আমি সুখী হবো?
– কেন হবে না, মেঘলা খুব ভালো মেয়ে ....
– শসস্..আর বলো না..আজ ওর কথা থাক।তোমার কথা বলো,আমি অনেক অন্যায় করেছি তোমার সাথে। সেই আভিযোগ গুলো আজকে শুনতে চাই আমি,কোন কিছুই গোপন রেখো না আর। শুধু এটুকু দয়া কর আমায়।
মনে হয় চোখে দুটো আদ্র হয়ে এসেছিল,ভাবী উঠে বসে আমার গালে হাত দিয়ে তার মুখটা খুব কাছে টেনে নিল। তারপর দু জোড়া ঠোঁটের সাথে দুজোড়া চৈখের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।যখন ঠোঁটের বাঁধন মুক্ত হলো,তখন ভাবীর গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট দুঠোই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে। আমার চোখের জল মুছতে মুছতে ভাবী বলল,
– সেই গুলো আমারই থাক,যখন তুমি ছিলে না তখন ওই স্মৃতি গুলো বুকে আকড়ে বেচেঁ ছিলাম। ওগুলো ছিনিয়ে নিও না।
আমি কিছু বলতে চাইছিলাম কিন্তু ভাবি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে থামিয়ে বলল, আর কোন কথা নয়।যদি সত্যিই কিছুই দিতে চাও তবে এটুকুই চাইবো, আর একা ছেড়ে যেওনা। আমি কাছে থেকে তোমায় সুখী দেখতে চাই। অনেক সুখ তুমি আমায় দিয়েছো এবারের আমাকে তোমার একটু পাশে থেকে ��কটু সেবা করতে দায়,তুমি সুখী হও, এর চেয়ে বেশি আমার আর কিছুই চাই না।
কাঁচের জানালা ভেদ করে সোনালী রোদের আলো প্রবেশ করতেই অন্ধকার রুমে কিছুটা আলো ছেয়ে পরলো।আমি নিঃশব্দে বসে তার চলে যাওয়া দেখলাম।.... আজকেও কোন প্রশ্ন নয়।আসলে প্রতেকটি গল্পই অনেক প্রশ্ন রেখে যায়, সে সমাপ্ত হোক বা না হোক।তবে কিছু প্রশ্নের উত্তর অজানা থাকাই ভালো।